গ্রামের মেয়ে সবিতা
মায়া ভরা এই চেহারাটাও ওর জীবনের একটি দুঃখের কারণ। কেন যেন সবাই তাকে খুব তাড়াতাড়ি আপন করে নেয়। মায়ার বাধনে বাঁধতে চায়। ফাদারের চেষ্টায় পি.জি হাসপাতালে সবিতার চাকুরী হয়ে যায়। মন দিয়ে সেবা করে, দুঃখী মানুষের মাঝে ও ওর হারিয়ে যাওয়া মা বাবা ভাইকে খুঁজে বেড়ায়। সত্যি সত্যি একদিন ওর আশা বাস্তবে রূপ নেয়। সেদিন কি একটা কাজে আউটডোরে গিয়েছিল। হঠাৎ লাইনে দাঁড়নো একজন মহিলাকে দেখে ওর কেমন যেন চেনা চেনা মনে হলো। মনের মধ্যে হঠাৎ চিৎকার দিয়ে উঠলো। সবিতা পায়ে পায়ে এগিয়ে যায় মধ্যবয়সি সেই মহিলার দিকে। জীর্ণ বসনে দারিদ্রতার চাপে চেহারাটি বিকৃত হয়ে গেছে তবুও মনে হলো উনি যেন ওর কত আপন। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সবিতা। হঠাৎ মহিলা চোখ তুলে তাকালো সবিতার দিকে। পলকহীন ভাবে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ তারপর একটি চিৎকার দিয়ে বেহুস হয়ে পড়লো।
সবিতা দৌড়ে গিয়ে তাকে ধরে তাড়াতাড়ি করে ইমারজেন্সিতে নিয়ে গেল। কিছুটা শুস্রষা করার পর ফিরে এলো জ্ঞান। সবিতার স্মৃতিতে খুজে ফিরছে মহিলার চেহারা। জ্ঞান ফিরেই মহিলা বলে ওঠে আমার সবিতা। আমার সবিতা কই? আমার মেয়ে ? সবিতা এগিয়ে যায় মহিলার দিকে বলে ‘এই যে আমি’। আপনি আমাকে চেনেন? মহিলা ওকে বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে বলে তুই আমার সবিতা। আমার হারিয়ে যাওয়া মেয়ে? সবিতার স্মৃতিতে তখন ধরা পড়ে মায়ের মুখ। মিলিয়ে দেখতে চেষ্টা করে। আবছা আবছা মিলে যায়। সবিতা সবকিছু ভুলে মায়ের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে বলে- ‘মাগো, আমি তোমার হারিয়ে যাওয়া মেয়ে সবিতা।’ দুজনের চোখ দিয়ে নেমে আসে শ্রাবনের অশ্রুধারা। হঠাৎ দৌড়ে আসে একটি যুবক ছেলে। মা মা বলে ডাকতে থাকে। সবিতা মাকে ছেড়ে ছেলেটির দিকে তাকায়। তাহলে কি এই ওর সেই আদরের ছোট্ট ভাই রতন? রতন মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে ‘কি হয়েছে মা। তুমি এখানে কেন?’ ‘ওরে রতন আমি সবিতাকে খুজে পেয়েছি। এই দেখ ও আমার সবিতা। সেই ছোট বেলায় হারিয়ে গিয়েছিল।’ রতনের মুখ থেকে বেরিয়ে আসে ‘দিদি’ সবিতা রতনকে বুকে টেনে নেয়। এদিকে খবর পেয়ে কয়েকজন ডাক্তার ছুটে আসে ইমার্জেন্সিতে। তারা এই দৃশ্য দেখে অভিভুত হয়ে পড়ে। সবাই সবিতার কথা জানতো। সবিতা ওর মাকে খুজে পাওযায় সবাই খুশি হয়। ডাক্তারের পরামর্শে সবিতা মাকে একটি কেবিনে ভর্তি করে দেয়। সময় তার নির্দিষ্ট গতিতে চলতেই থাকে। সবিতা এতোদিন নার্স হোষ্টেলে থাকতো। মা বাবা ভাই বোন পেয়ে এখন সে পিজি’র কাছেই একটি বাসা ভাড়া নিল। সবিতাকে হারিয়ে ওর মা অসুস্থ হয়ে পড়ে। কিছুটা অপ্রকৃতস্থ হয়ে পড়ায় সবিতার বাবা আর ভারত যেতে পারেনি। মানুষের শ্রোতের সাথে মিশে এক সময় কুষ্টিয়ার এক গ্রামে আশ্রয় মেলে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সবিতার বাবা তাদের গ্রামের বাড়ীতে ফিরে এসে দেখে তাদের পুড়ে যাওয়া ঘরবাড়ীতে নতুন বাড়ী তৈরী হয়েছে। ওদেরকে ভয় দেখানো হল। জীবনের ভয়ে ওরা আবার অনিশ্চিতের পথে পা বাড়ায়। অসুস্থ স্ত্রী আর ছোট্ট একটি ছেলেকে নিয়ে শেষে ঠাঁই হয় ঢাকার এক বস্তিতে। দিন মজুর খেটে সবিতার বাবা কোন মতে চলতে থাকে। চিকিৎসার পয়সা যোগার করা আর সম্ভব হয়না। অনেকে পরামর্শ দেয় আর একটি মেয়ে হলে হয়তো সে স্বাভাবিক হয়ে যাবে। সে চিন্তা করে সবিতার বাবা সন্তান নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। সৃষ্টি কর্তার ইচ্ছায় সবিতার মা একসাথে দুটি কন্যা সন্তানের জন্ম দেয়। অভাবের এই সংসারে আরও দুজন সদস্য বেড়ে যায়। হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খেটে সবিতার বাবা এই পাঁচ জনের সংসারটা টানতে টানতে এ পর্যন্ত এনেছে।
অতীতের কথা শুনতে শুনতে সবিতার চোখ বেয়ে পানি নেমে আসে। মাকে বুকের মধ্যে নিয়ে বলে ‘আর আমি তোমাদের কোন কষ্ট করতে দেব না মা। বাবাকেও না। আমি সব ব্যবস্থা করবো। তোমাদের আর কোন চিন্তা করতে হবে না।’ এদিকে বাবা মাকে বুঝিয়ে ওদের ধর্মান্তর করে। সবিতা পাদ্রি বাবার সাহায্যে ওদের ভিটে বাড়ী উদ্ধারের চেষ্টা চালায়। শেষে বাড়ীর দাম হিসাবে ২ লক্ষ টাকা পেয়ে ছোট ভাইটিকে ফার্মগেটে একটি ষ্টেশনারী দোকান করে দেয় সবিতা। ছোট বোন দুটিকে খৃষ্টান স্কুলে ভর্তি করে দেয়। নিজে ওভার টাইম খেটে এই ভেঙ্গেপড়া সংসার টিকে ধংসের হাত থেকে টেনে তুলতে চেষ্টা করে। সময়ের গতিধারায় সবিতার জীবনে প্রেম আসে। চলার পথে ভুবনের সাথে ওর দেখা হয়। স্মার্ট ও সুন্দর চেহারার অধিকারী এই যুবক। বাবা মা নেই। বিএ পাশ করে চাকুরীর চেষ্টা করছে। ভুবনের ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে সবিতা ওকে ভালবেসে ফেলে। ভুবনও কিছুদিনের মধ্যে ওদের বাড়ীর একজন হয়ে পড়ে। শেষে বাবা মায়ের চাপে ওদের বিয়ে হয়ে যায়। ভুবন সবিতার সংসারেই বাসা বাঁধে। সবিতার চেষ্টায় একটি চাকুরী জুটে যায় ভুবনের। বেশ চলছিল ওদের এই নতুন সংসার। কিছু দিনের মধ্যে সবিতার কোল জুড়ে এলো একটি ছোট্ট সন্তান। অগ্নিলা। হ্যাঁ ভুবন সবিতার সন্তান অগ্নিলা। রতন নিষ্ঠার সাথে ওর দোকান নিয়ে ব্যস্ত থাকে সারা দিন। এভাবেই চলছিল ওদের সংসার। হঠাৎ করেই একটি প্রস্তাব পেয়ে সবাই বসলো পরামর্শ করতে। পিজির ডাইরেক্টর সাহেব সবিতাকে খুব স্নেহ করেন। সৌদি আরবের রিয়াদে একটি হসপিটালে কিছু নার্স চেয়েছে। ডাইরেক্টর সাহেব সবিতাকে এই সুযোগটি নিতে পরামর্শ দেন। সরকারী ভাবে যাওয়া। ওখানে সরকারী কোয়াটার। তাছাড়া অনেক বেতন। লোভনীয় প্রস্তাব। কিন্তু মাত্র ৬ মাসের শিশু অগ্নিলাকে ছেড়ে কিভাবে থাকবে সবিতা? অনেক তর্ক বির্তক ও আলোচনার পর সিদ্ধান্ত হলো সবিতা রিয়াদে যাবে। মাত্র ৫টি বৎসর। এই ৫টি বৎসরে ওদের সব দুঃখ কষ্ট দুর হতে পারে। তাই এই সুবর্ণ সুযোগ ছাড়া ঠিক হবে না। সিদ্ধান্ত হলো ভুবন চাকুরী ছেড়ে দিয়ে বাসা দেখাশোনা করবে। ছোট বোন নমিতা ও ববিতা আর মা অগ্নিলাকে লালন করতে পারবে। সবিতা খুবই বুদ্ধিমতি মেয়ে। সবদিক চিন্তা করে পাদ্রি বাবার পরামর্শে গ্রীন্ডলেস ব্যাংকে একটি এফসি একাউন্ট খুলে গেল।
আর ব্যাংককে পরামর্শ দিল যে প্রতি মাসে এই একাউন্ট থেকে দশ হাজার টাকা ভুবনকে প্রদান করতে হবে। রতনের দোকানের কিছুটা আয় আর এই দশ হাজার টাকা দিয়ে ভুবনকে সংসার নামক গাড়ীটি চালাতে হয়। ভুবন সবকিছু ভুলে সবিতার অসুস্থ মা, বেকার বাবা, স্কুলে পড়া দু’টি বোন, ভাই রতন আর মেয়ে অগ্লিলাকে নিয়ে নিজের মত একটি পৃথিবী গড়ে তোলে। সারাদিন প্রতিটি কাজ নিজে হাতে করে ওদের বুক দিয়ে আগলে রাখে। ভুলে যায় সবিতার উষ্ণ শরীরের পরশ। প্রতিক্ষায় থাকে সবিতার প্রত্যাবর্তনের পথের দিকে। সবিতা পাড়ী জমায় সুদুর আরবের রিয়াদ শহরের নাম করা এক হাসপাতালে। কিছু দিনের মধ্যেই ওর স্বভাব আর ব্যবহার দিয়ে সকলের মন জয় করে ফেলে। অনেক বড়লোক রোগী ওর সেবায় মুগ্ধ হয়ে যাবার সময় প্রচুর উপহার আর অর্থ প্রদান করে যায়। সবিতা সব কিছু বুদ্ধিমতির মত সংরক্ষণ করে। দেশের খবরা-খবরের জন্য সারাক্ষণ উদ্বিঘ্ন থাকে। যদিও জানে ভুবন ওদের সবাইকে নিজের প্রাণের চেয়েও বেশী ভালবাসে তবুও মাঝে মাঝে অগ্নিলার জন্য বুকের মধ্যে হু হু করে উঠে। তাই ভুবনকে একটি টেলিফোন নিতে বলেছে। হাসপাতাল থেকে বিনে পয়সায় দেশের খবর নিতে পারবে। কথা মত চেষ্টা তদবির করে খুব তাড়াতাড়ি একটি টেলিফোন জোগার করে ফেলে ভুবন। এখন প্রায়ই সবিতার সাথে ওদের কথা হয়। সময়ের আবর্তে সবিতার জীবনে নেমে আসে এক কঠিন সময়। সৌদি আরবের একজন সরকারী বড় অফিসার অসুস্থ হয়ে সবিতাদের হাসপাতালে আসেন। ডাইরেক্টর সবিতাকে ওনার দেখা শুনার ভার দেন। সবিতা মন দিয়ে সেবা করে ওনাকে সুস্থ্য করে তোলে। কিন্তু সেই সেবাই ওর কাল হয়ে দাঁড়ায়। অফিসার ওর সেবায় মুগ্ধ হয়ে ওকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। সবিতা অনেক চিন্তা করেও কোন কুল কিনারা করতে পারেনা। সৌদি সরকারী ঐ অফিসার খুবই প্রভাবশালী ও প্রতিপত্তির মালিক। ওনাকে ফিরিয়ে দেয়া কোন ভাবেই সম্ভব নয়। শেষে সবিতা ওনার সামনাসামনি হয়। বুঝিয়ে বলে ও বিবাহিতা, ওর একটি ছোট্ট মেয়ে আছে। তাছাড়া ওর মা বাবা অসুস্থ। দুটো ছোট বোন লেখাপড়া করে। তাই ওর পক্ষে ওনাকে বিয়ে করা সম্ভব নয়। আবার ওনাকে ফিরিয়ে দেয়াও ঠিক নয়। তাছাড়া প্রতিটি মানুষেরই আত্ম সন্মান আছে। আত্ম সন্মান বিকিয়ে দিয়ে …..।
সবিতাকে আর কিছু বলতে হয়নি। অফিসার সবিতার অবস্থা চিন্তা করে বলেন-‘ঠিক আছে আমি তোমাকে আমার হাউস নার্স হিসাবে নিয়োগ দেব। তুমি আমার অফিস থেকে মাসে ৫ হাজার রিয়াল পাবে। বিনিময়ে তুমি প্রতি সপ্তাহে একদিন আমাকে চেকআপ করতে আমার বাড়ী যাবে। আমি হাসপাতালের ডাইরেক্টরকে জানিয়ে দেব। এতে তোমার কোন সম্মানের অমর্যাদা হবে না।’ সবিতা রাজি হয়ে যায়। প্রতি সপ্তাহের রবিবার ওর অফ ডে সেদিন ঐ অফিসারের গাড়ী এসে অফিস থেকে ওকে নিয়ে যায়। সারারাত থেকে পর দিন হোষ্টেলে ফিরে আসে সবিতা। এমনি করে চলতে থাকে সময়। এরই মধ্যে সবিতা প্রচুর অর্থ উপর্জন করে ফেলে। বুদ্ধিমতি সবিতা সব টাকা দেশের ব্যাংকে জমাতে থাকে। কিন্তু কেউ জানতে পারে না ওর কত টাকা। এদিকে ভুবন সবিতার স্মৃতি মনে করে প্রতিক্ষায় অপেক্ষা করতে থাকে কখন সবিতা ফিরে আসবে। অগ্নিলাকে বুকে নিয়ে ভুবন সব কিছু ভুলে থাকতে চায়। কিন্তু মানুষতো? বার বার স্মৃতির দুয়ারে এসে অতীতের অনেক কথা মনে পড়ে ভুবনের। ভুবন একটি বারের জন্যও ভাবতে পারেনা যে ও যখন সবিতার স্মৃতিতে বিভোর তখন সবিতা হাজার হাজার মাইল দুরে একজন শেখের লোমশ বুকে মাথারেখে তার আদরে আদরে নিজেকে ভরে তুলছে। সবিতা ভুবনের সাহায্যে ফার্মগেটের কাছেই পূর্ব রাজা বাজারে একটি প্লট ক্রয় করে। ধীর ধীরে সবিতার দেশে ফেরার সময় হয়। অনেক অনেক উপহার সামগ্রী আর প্রচুর জিনিস পত্র নিয়ে দেশে ফিরে আসে সবিতা। ভুবন নমিতা, ববিতা আর অগ্নিলাকে নিয়ে এয়ার পোর্টে গিয়েছিল সবিতাকে রিসিপশান দেয়ার জন্য। ভুবন একনজর মাত্র দেখেছিল সবিতাকে। ও অনেক সুন্দরী হয়েছে। বিদেশ থাকলে মানুষতো সুন্দর হবেই। তারপর সবিতার জিনিসপত্র নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে ভুবন। অনেক কষ্ট করে সব কিছু গোছগাছ করে ফিরে আসে বাসায়। সারাক্ষণ শুধু ফাঁক খোজে একটি বার সবিতার সাথে মন খুলে একটু আলাপ করবে। ওকে বুকের মধ্যে নিয়ে একটু আদর করবে। কিন্তু সে সুযোগ হয়না। অনেকটা সবিতা ইচ্ছে করেই সে সুযোগ দেয় না। শেষে অনেক রাতে সবিতাকে একান্তে পেয়ে ভুবন বলে- ‘কেমন ছিলে সবি? আমার কথা তোমার একবারও মনে হয়নি? ‘মনে হবে না কেন। সব সময়ই মনে হয়েছে। তবে আজ আমি খুব টায়ার্ড, ভীষণ ঘুম পাচ্ছে।
প্লিজ আজ আর ডিষ্টার্ব করো না।’ বলেই মেয়েকে বুকে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে সবিতা। ভুবন কিছুই বলতে পারে না। শুধু ঘুমন্ত সবিতার মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবে-‘এই কি সেই সবিতা? যাকে ও ভালবেসে বিয়ে করেছিল ? বিদেশ যাওয়ার আগে যে সবিতা ওকে ছাড়া কিছুই বুঝতো না সে………। আর ভাবতে পারে না দুচোখ বেয়ে অশ্রু নেমে আসে। ২/৩ দিন খুব ব্যস্ততার মধ্যে কেটে যায় সবিতার। সবিতা পুনরায় পি.জি.তে জয়েন করেছে। ভুবন সারাক্ষন ব্যস্ত। সবিতার জন্য বাড়ী বানাতে হবে। রাজাবাজার যে প্লটটি কিনেছে সেখানে ৫তলা বাড়ী বানাতে হবে। সেসব নিয়ে সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে ভুবনকে। সবিতা খুবই হিসেবি মেয়ে। দেশে ফিরে আসার আগে ও ইচ্ছে করেই জন্ম নিয়ন্ত্রন করেনি। ওর ইচ্ছে ছিল সৌদি অফিসারে সন্তান আসুক ওর গর্ভে। তাই এমন ভাবে হিসেব করে বাচ্চা নিয়েছে যে কেউ যেন সন্দেহ করতে না পারে। দেশে ফেরার পর এক মাস পরেই জানিয়ে দেয় সে মা হতে চলেছে। এটা হতেই পারে। কথাটি শুনে ভুবনও খুশি হয়। ভাবে বাচ্চাটি হলে সবিতা হয়তো পূর্বের মত ওর সাথে সুন্দর ব্যবহার আর ভালবাসার নুতন সেতু সৃষ্টি হতে পারে। কিন্তু ভুবন সবিতাকে চিনতে পারে নি। সবিতা সৌদি শেখের একটি চিহ্ন বহন করে এনেছে। যা ভুবনের নামে চালিয়ে দেবে। একজন মা ই শুধু বলতে পারে তার গর্ভের সন্তান কার। সারাদিন হাড়ভাঙ্গা খাটুনির পরও সবিতার একটু মিষ্টি কথা শুনতে পায়না ভুবন। ভুবন যেন সবিতার কেনা গোলাম। শুধু কাজ করার জন্যই ওকে রাখা হয়েছে। আজকাল আবার প্রতিটি কাজে ভুল ধরা একটি স্বভাবে দাঁড়িয়েছে সবিতার। সবিতার শরীর খারাপ বলে কোন প্রতিবাদ করতে পারে না ভুবন। কিন্তু সহ্যেরতো একটা সীমা আছে। ভুবন অনেক কষ্টে নিজেকে থামিয়ে রাখে। অনেক ঘটা করে একটি পুত্র সন্তান জন্ম দেয় সবিতা। সবাই দেখে বলে ছেলে নাকি রাজপুত্রের মত চেহারা হয়েছে। অগ্নিলার চেহারার মধ্যে যেমন ভুবনের চেহারার কিছুটা ছাপ আছে পুত্র রাহুলের মধ্যে তেমনটি খুজে পাওয়া গেল না। ইতোমধ্যে সবিতার ৫ তলা বাড়ী তৈরী হয়ে ভাড়াও হয়ে গেছে। তিনতালায় ওরা থাকে। বাকী ৮টি ফ্যাট ব্যাসেলর কোয়াটার হিসেবে ভাড়া দেয়া হয়েছে। এখানে কয়েটি বাড়ী মিলে এই সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে। সব বাড়ীতেই ব্যাসেলর ভাড়াটিয়া।
ভুবন এখন ভাড়া তোলার ম্যানেজার। বাড়ী দেখা শোনা, বাজার ঘাট করা, বৈদুতিক বিল, গ্যাস বিল, বাড়ীর বিভিন্ন ট্যা্কশ ইত্যাদি পরিশোধ করাই এখন ভুবনের কাজ। মেয়েকেও স্কুলে আনা নেয়া করতে হয় ভুবনের। মেয়েটি মাঝে মাঝে বাবার কোলে মাথা রেখে বলে ‘বাবা তোমার খুব কষ্ট হয় তাই না। মা টা যে কি? তোমাকে একটুও ভালবাসে না। সারাক্ষণ শুধু বকা ঝকা করে। আমার খুব খারাপ লাগে বাবা। তুমি প্রতিবাদ করো না কেন?’ ভুবন মেয়ের কথার কোন উত্তর দিতে পারে না। শুধু মেয়ের মাথায় হাত দিয়ে বলে ‘মারে, জীবনের চলার পথের ভিত্তি সৃষ্টি হয় বিশ্বাস থেকে, সেই বিশ্বাস যখন নষ্ট হয়ে যায় তখন জীবনে নেমে আসে বিপর্যয়। বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে প্রতিবাদ করে কোন লাভ হয় না মা। আমার জীবন তো শেষ, তোরা ভাল থাকিস মা। কখনও বিশ্বাসের অমর্যাদা করিস না।’ অগ্নিলা বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। মনের মধ্যে একটি ব্যাথা চিন চিন করে ওঠে। শুধু ভাবে মা টা এমন হলো কেন? সময় তার নিজস্ব গতিতে আরও দুটি বছর পার করলো। ভুবনের উপর অত্যাচার চরমে উঠে গেল। ভুবন বুঝতে পারছে সবিতার কাছে ওর প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে। গ্রামের মেয়ে সবিতা তাই ওর কাছ থেকে দুরে সরে যাওয়াই শ্রেয় মনে করলো। তাই ভুবন শেষ বারের মত সবিতার মুখোমুখি দাঁড়ায়। ‘আমার মনে হয় তোমার জীবনে আমার আর কোন প্রয়োজন নেই।’ ‘এই সহজ কথাটি তুমি এতোদিনে বুঝলে?’ ‘বুঝেছি অনেক আগেই, ভেবে ছিলাম তোমার ভুল হয়তো একদিন ভাংবে তাই অপেক্ষা করছিলাম।’ ‘ভুল?’ ‘হ্যাঁ ভুল। হিসেবের ভুল’ ‘সবিতা কখনও হিসাবে ভুল করে না। তুমিও যখন আমাকে সন্দেহ করতে শুরু করেছো তখন এক ছাদের নিচে আর বাস করা যায় না।’ ‘সন্দেহ আমি করিনি। সন্দেহ তুমি সৃষ্টি করেছো। আর আমার চোখে ধুলো দিলেও অন্যদের চোখে ধুলো দেবে কিভাবে?’ ‘ধুলো আমি কারো চোখেই দিতে চাই না। আমি চাই তুমি আমার জীবন থেকে সরে যাবে। ব্যাস।’ ‘ঠিক আছে। আমিও তোমার জীবনে থাকতে চাই না। আমার ছেলে-মেয়েকে নিয়ে আমি চলে যাব।’ ‘তোমার ছেলে?’ সবিতা সাপিনীর মত ফোঁস করে উঠে। ‘হ্যাঁ আমার ছেলে রাহুল।
ওকে আমি নিয়ে যাব। আমি ওর জীবনে তোমার মত ডাইনির ছায়া পড়তে দেব না’ ‘রাহুল তোমার ছেলে? তুমি বিশ্বাস করো?’ ‘কেন করবো না। তুমিতো বলেছো রাহুল আমাদের ছেলে?’ ‘ভুল করেছি। তুমি ওকে আমার কাছে থেকে কেড়ে নেবে জানলে আমি কখনও তোমার পরিচয় দিতাম না’ রাগে ফোঁস ফোঁস করতে থাকে সবিতা। ভুবন এই সময়টারই অপেক্ষা করছিল। কারণ রাগের সময় অনেক সত্য কথা বেরিয়ে আসে। ‘তাহলে বলো রাহুল কার ছেলে? বলো?’ ‘রাহুল আমার ছেলে। গ্রামের মেয়ে সবিতা আমি ওর মা।’ ‘সেতো সবাই জানে তুমি ওর মা, কিন্তু বাবা কে?’ ‘বাবা তুমি না’ ‘আমি না তবে কে?’ হঠাৎ সবিতা জ্ঞান ফিরে পেয়ে বুঝতে পারে সে কি বলছে। ভুবন সবিতার দিকে তাকিয়ে হেসে বলে -‘সবিতা সত্য কখনও চাপা দিয়ে রাখা যায় না। সত্য একদিন না একদিন প্রকাশ পেয়েই যায়। আমি রাহুলকে নেব না। শুধু আমি যে ওর বাবা নই সেটাই পরীক্ষা করে নিলাম। তোমার ছেলে তোমার কাছেই থাকবে। তবে আমি তোমার মত একজন বেস্যা নারীর কাছে আর এক মুহুর্তও থাকবো না।’ সবিতার কানে কেযেন গরম শিশা ঢেলে দিল। পরক্ষণেই টেবিলের উপর থেকে রাহুলের একটি শক্ত খেলনা নিয়ে ছুড়ে মারলো ভুবনের দিকে। ভুবন মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে। দর দর করে রক্ত হাত বেয়ে মেঝেতে পড়তে থাকে। ভুবন মাথার ক্ষত স্থানে হাত দিয়ে চেপে ধরে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। যাওয়ার পথে শুধু বলে-‘সবি, ভালবাসার প্রতিদান তুমি এভাবেই দিলে? তুমি কখনও সুখি হতে পারবে না’ ভুবন বাড়ীর সামনের ডিসপেনসারীতে গিয়ে ফাষ্ট এইড নেয়। মাথায় ব্যন্ডেজ বেধে ডাক্তার খানা থেকে বেরিয়ে ওর গড়া ৫ তলা বাড়ীটির দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনে মনে বলে-‘ঈশ্বর মানুষকে প্রয়োজনের বেশী অর্থ দিও না। অর্থ মানুষকে অমানুষ করে।’ তারপর অজানা পথের দিকে পা বাড়ায়।
No comments:
Post a Comment