বড় মাই মর্দন
কোন অনুরোধেই কাজ না হওয়াতে শেষে গালি দিতে লাগল অঞ্জন। আরও বড় হয়ে যাচ্ছে নিশ্চয় কুকুরটার শরীর। মুখে ঝুলে থেকে ঠিক বুঝতে পারছে না অঞ্জন। দু’দিকে ঝুলে পড়েছে ওর হাত-পা। মাটি থেকে কয়েক ফুট ওপরে রয়েছে। ‘রাখ না আমাকে! মাটিতে নামা, শয়তান কুত্তা!’ ককিয়ে উঠল অঞ্জন। বাড়ির পিছনের আঙিনায় নিয়ে এসেছে ওকে কুকুরটা। সবুজ ঘাসের দিকে তাকিয়ে আছে অঞ্জন। হাঁটার তালে তালে হাঁপাচ্ছে নেড়ি। ফোঁস ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলছে। শব্দটা ভয়ানক পীড়া দিচ্ছে অঞ্জনের কানে। কাপড়-চোপড় সব ভিজে গেছে কুকুরের আঠাল লালায়। আসলে ও আমার ক্ষতি করতে চায় না, নিজেকে অভয় দিল অঞ্জন। আমার সঙ্গে শুধু খেলতে চায়। ভাগ্যিস বুড়ো হয়েছে কুকুরটা। দাঁতগুলো ক্ষয়া। নতুন দাঁতের মত ধারাল নয়। ফুলের বাগানের কিনারে এসে থামল নেড়ি। মাটির কাছাকাছি নামাল অঞ্জনকে, কিন্তু মুখ থেকে ছাড়ল না। সামনের দুই থাবা দিয়ে নরম মাটি আঁচড়ানো শুরু করল। ‘ছাড় আমাকে!’ গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে উঠল অঞ্জন। ‘নেড়ি। আমার কথা শোন।’ জোরে জোরে দম নিচ্ছে কুকুরটা। অঞ্জনের গায়ে লাগছে গরম নিঃশ্বাস। নাকে লাগছে কুকুরের মুখের দুর্গন্ধ। অসহ্য! দ্রুত মাটি খুঁড়ছে নেড়ি। গর্ত করছে। কুকুরটার উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে আতঙ্ক যেন রক্তে মিশে ঢেউয়ের মত বয়ে গেল অঞ্জনের শিরায় শিরায়।
আবারও চিৎকার করে উঠল, ‘না না, নেড়ি! আমাকে কবর দিস না!’ আরও দ্রুত বিশাল থাবার নখ চালাল কুকুরটা। মাটির কণা উড়ে এসে পড়তে থাকল অঞ্জনের মুখে। ‘আমি হাড় না, নেড়ি!’ পাগলের মত চিৎকার করতে থাকল অঞ্জন। ‘আমি অঞ্জন। আমাকে কবর দিস না, কবর দিস নাঃ’ দুই হাসির শব্দে চমক ভাঙল অঞ্জনের। মাথা তুলে বোকার মত চারপাশে তাকাল। ক্লাসের মধ্যে রয়েছে ও। স্কুলে। সামনে পিছনে সারি সারি বেঞ্চ। ছাত্রছাত্রীরা তো বটেই, সাইন্স টিচার হারুণ সারও তাকিয়ে রয়েছেন ওর দিকে। অঞ্জনের পাশেই দাঁড়ানো। তাঁর মোটা ভুঁড়ি জানালা দিয়ে আসা আলো ঢেকে দিচ্ছে যেন। অঞ্জনের মুখের কাছে হাত নেড়ে নাটকীয় ভঙ্গিতে বলতে লাগলেন, ‘অঞ্জন, এই অঞ্জন, এই হচ্ছে কী। কে তোমাকে কবর দিচ্ছে?’ আবার হেসে উঠল ছেলেমেয়েরা। কান গরম হয়ে যাচ্ছে অঞ্জনের। ‘স-স-সরি, সার!’ ‘জেগে জেগে স্বপ্ন দেখছিলে নাকি?’ সারের কুতকুতে চোখে বাঁকা হাসির ঝিলিক। ‘না, সার,’ ঢোক গিলে অঞ্জন বলল। ‘ভূতুড়ে রক্তের কথা ভাবছিলাম। ওটার কথা আমি কোনমতেই মন থেকে সরাতে পারছি না।’ গত গ্রীষ্মের ছুটিতে প্রথম দেখেছিল ভূতুড়ে রক্ত। ভয়ানক কাণ্ড করে ছেড়েছিল নীল রঙের আঠা আঠা পেস্টের মত জিনিসটা। ‘অঞ্জন, দয়া করে মগজ থেকে তাড়াও না ভাবনাটা!’ অধৈর্য ভঙ্গিতে হাত নাড়লেন সার। গোল টাক মাথাটা ঘন ঘন নেড়ে, জিভ আর টাকরার সাহায্যে চুক-চুক শব্দ করে যেন করুণার দৃষ্টিতে তাকালেন অঞ্জনের দিকে। ‘কিন্তু সার, ভূতুড়ে রক্ত সত্যি আছে!’ বিশ্বাস করাতে না পেরে রেগে গেল অঞ্জন। আবারও হেসে উঠল ছেলেমেয়েরা। কঠিন হয়ে গেল সারের মুখ।
চোখের দৃষ্টি আটকে গেল অঞ্জনের চোখে। ‘অঞ্জন, আমি বিজ্ঞানের শিক্ষক। এরকম গাঁজাখুরী গল্প কোন সাইন্স ফিকশন লেখককে হয়তো বিশ্বাস করাতে পারবে, আমাকে পারবে না।’ ‘কিন্তু বিশ্বাস করুন, সার। ওরকম জিনিস সত্যিই আমি পেয়েছিলাম,’ অঞ্জন বলল। ‘একটা পুরানো দোকানে। নানা ধরনের অদ্ভুত অদ্ভুত খেলনা বিক্রি করে ওরা। কোত্থেকে আনে, খোদাই জানে! আমি যেটা পেয়েছি, কৌটায় ভরা ছিল জিনিসটা। আঠা আঠা নীল রঙের খুব ঘন এক ধরনের পেস্টের মত জিনিস। কৌটার মুখ খোলা রাখলে আপনাআপনি বাড়তে থাকে। এটাই খেলা। কেউ খেলে বড় হতে হতে দানব হয়ে যায়, সেটা জন্তুই হোক কিংবা মানুষ। আমার কুকুর নেড়ি সামান্য একটু খেয়েছিল, আর তাতেই বড় হতে হতে ঘোড়ার সমান হয়ে গিয়েছিল।’ ‘বললাম তো, অঞ্জন, এ সব গপ্পো সাইন্স ফিকশনের লেখককে হয়তো বিশ্বাস করাতে পারবে,’ হেসে বললেন সার, ‘সাইন্স ফিকশনের টিচারকে নয়।’ ‘আসলে বোকা মানুষকে কোন কিছু বলেই লাভ নেই!’ মুখ ফসকে বলে ফেলল অঞ্জন। বলেই বুঝল, মস্ত ভুল করে ফেলেছে। এবং এরজন্য খেসারত দিতে হবে ওকে। স্তব্ধ হয়ে গেল ক্লাস। চারিদিকে ফিসফাস, গুঞ্জন। হারুণ সারের মুখটা টকটকে লাল হয়ে গেল। বোমার মত ফেটে পড়তে পড়তেও সামলে নিলেন অনেক কষ্টে। শার্টে ঢাকা ভুঁড়িওয়ালা পেটটা দু’হাতে ডলে রাগ কমানোর চেষ্টা করছেন। ‘অঞ্জন, তুমি এই স্কুলে নতুন, তাই না?’ অবশেষে বললেন তিনি। ধীরে ধীরে রক্ত সরে যেতে শুরু করেছে মুখ থেকে। তবে পুরো স্বাভাবিক হতে সময় লাগবে, বুঝতে পারছে অঞ্জন। ‘হ্যাঁ,’ প্রায় ফিসফিস করে জবাব দিল সে। ‘এই কিছুদিন হলো নোয়াখালি থেকে এসেছি।
অঞ্জনের বাবা ইসলাম সাহেব সরকারি বড় চাকরি করেন। নোয়াখালিতে পোস্টিং ছিল। এখন ঢাকায় বদলি হয়েছেন। উত্তরায় বাসা। অঞ্জনকে ভর্তি করেছেন এখানকার একটা অতি আধুনিক, হাই স্কুলে। ছেলেমেয়ে একসঙ্গে পড়ে এখানে। প্রচুর খরচ। এ-সব কথা ভাবছিল অঞ্জন, টিচারের কথায় বাস্তবে ফিরে এল। তিনি বলছেন, ‘তারমানে এখানকার পরিবেশের সঙ্গে পরিচিত নও তুমি। হতে পারে তোমার পুরানো স্কুলের টিচাররা এতটাই নরম মনের কিংবা দুর্বল স্বভাবের মানুষ, বোকা বলে গালি দিলেও কিছু মনে করেন নাঃ’ ‘না, সার,’ লজ্জিত স্বরে অঞ্জন বলল, ‘তাঁরা মোটেও বোকা নন। আসলে মুখ ফসকে বলে ফেলেছি, মাপ করে দিন।’ ক্লাস জুড়ে হাসির শব্দ। সারকে ‘বোকা’ বলাতে খুব মজা পেয়েছে ছেলেমেয়েরা। হাসি আর থামে না ওদের। জ্বলন্ত চোখে অঞ্জনের দিকে তাকালেন হারুণ সার। ভ্রƒকুটিতে কুঁচকে গেছে কপাল। উহ্, বোকাটা সরে না কেন এখান থেকে-বলল অঞ্জন, তবে এবার মনে মনে। বিপদ আসছে, বুঝতে পারছে সে। ইস্, আমার হাঁদা মুখটা বন্ধ রাখতে পারি না কেন? এই মুখের কারণে বার বার বিপত্তি ডেকে আনি! দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকালেন হারুণ সার। ‘ছুটির সময় হয়ে এলো। প্রচুর সময় নষ্ট করলে আমাদের, অঞ্জন। সেটা পোষানোর জন্য একটা কাজ করতে হবে তোমাকে।’ অপেক্ষা করছে অঞ্জন। সাংঘাতিক কিছু আসছে, বুঝে ফেলেছে ও। ‘ছুটির পর তোমার বইখাতা লকারে রেখে এখানে ফিরে আসবে,’ হারুণ সার বললেন। ‘গুটুলের খাঁচাটা পরিষ্কার করবে।’ গুঙিয়ে উঠল অঞ্জন। দেয়াল ঘেঁষে রাখা খাঁচাটার দিকে তাকাল। ভিতরে রাখা একটা গিনিপিগ। সর্বনাশ! ভাবল অঞ্জন। গিনিপিগ অপছন্দ করে ও।
আর সেটা জানেন হারুণ সার। এর আগেও দু’বার জঘন্য ওই নোংরা খাঁচাটা সাফ করিয়েছেন ওকে দিয়ে। ‘গিনিপিগের খাঁচা সাফ করতে করতে হয়তো নিজেকে শুধরে নেবে তুমি, অঞ্জন,’ হারুণ সার বললেন। ‘হয়তো বুঝতে পারবে, বিজ্ঞানের ক্লাসে কী ধরনের আচরণ করতে হয়।’ লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল অঞ্জন। চেঁচিয়ে বলল, ‘আমি পারব না!’ আরেকবার স্তব্ধ হয়ে গেল ছেলেমেয়ের দল। ‘গিনিগিপ আমি দুচোখে দেখতে পারি না!’ অঞ্জন বলল। ‘হোঁৎকা ওই হাঁদা প্রাণীগুলোকে আমি ঘৃণা করি!’ আতঙ্কিত চোখে পুরো ক্লাস তাকিয়ে দেখল, খাঁচাটার কাছে ছুটে গেল অঞ্জন, হ্যাঁচকা টানে খাঁচার দরজা খুলল, ভিতরের প্রাণীটার ঘাড় চেপে ধরল এক হাত দিয়ে। তারপর হাতে ঝুলিয়ে গিনিপিগটাকে বের করে এনে খোলা জানালা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল বাইরে। তিন আরেকটা দিবাস্বপ্ন দেখল আসলে অঞ্জন। লাফিয়ে উঠে দাঁড়ায়নি ও, চিৎকারও করেনি, গিনিপিগটাকে জানালার বাইরে ছুঁড়েও ফেলেনি। পুরো ব্যাপারটাই ওর কল্পনা। রাগের মাথায় কত কিছুই করার কথা কল্পনা করে মানুষ, কিন্তু বাস্তবে সেটা সম্ভব হয় না। অঞ্জনও পারবে না, জানে ও। বরং মিনমিন করে বলল, ‘ঠিক আছে, সার।’ তারপর শান্তভাবে সিটে বসে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। নীল আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে তুলোর মত সাদা সাদা পেঁজা মেঘ। জানালার কাঁচে নিজের প্রতিবিম্ব দেখতে পেল ও। ওর চুলের রঙ স্বাভাবিকের চেয়ে গাঢ় দেখাচ্ছে কাঁচের ভিতর। কাঁদো কাঁদো হয়ে আছে চেহারাটা। সারা ক্লাসের সামনে এভাবে অপমানিত হয়ে প্রচণ্ড খারাপ লাগছে।
কেন সব সময় নিজেকে বিপদে ফেলে দিই আমি? ভাবছে অঞ্জন। হারুণ সারই বা কেন শুধু আমার পিছনেই লেগে থাকেন? স্কুলে নতুন আসাটা কি দোষের? কতটা নিষ্ঠুর আচরণ করছেন তিনি, সেটা কি বোঝেন না? সব সময় যদি এমন করতে থাকেন তিনি, কীভাবে এই স্কুলে টিকব আমি? কীভাবে নতুন বন্ধু জোগাড় করব, ক্লাস করব কী করে? ভূতুড়ে রক্ত সত্যিই আছে, এ কথা কাউকে বিশ্বাস করাতে পারছে না ও। খুব আগ্রহ নিয়ে নতুন স্কুলে ওর ক্লাসের ছেলেমেয়েদের কাছে ভূতুড়ে রক্তের গল্প বলেছে। কীভাবে গত গ্রীষ্মে কুমিল্লায় দাদুর বাড়িতে গিয়েছিল, সেখানে ইশা নামে একটা মেয়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছিল, অতি পুরানো একটা খেলনার দোকান থেকে ‘ভূতুড়ে রক্ত’-এর একটা কৌটা পেয়ে কিনে এনেছিল। তারপর সেই ভূতুড়ে রক্ত বাড়তে আরম্ভ করল। কৌটা ছাড়িয়ে বেরিয়ে এল। তখন একটা বড় বালতিতে কৌটাটা রেখেছিল ও, কিন্তু বাড়তে বাড়তে বালতি ছাড়িয়ে উপচে পড়া শুরু করল রক্ত। তখন বালতি সহ রাখল একটা বাথটাবে। বাথটাবটাও ভরে গিয়ে উপচে পড়তে লাগল রক্ত। দেখে মনে হচ্ছিল, প্রাণ আছে ওই রক্তের, জীবন্ত প্রাণীর মত বেড়েই চলেছে। নতুন স্কুলে সহপাঠীদের বলেছে অঞ্জন, কীভাবে খুব সামান্য একটু রক্ত খেয়ে বড় হতে শুরু করেছিল নেড়ি। বড় হতে হতে একটা বাড়ির সমান হয়ে গিয়েছিল। ভয়াল, বিস্ময়কর এক ঘটনা। অঞ্জন ভেবেছিল, শুনে মুগ্ধ হবে ছেলেমেয়েরা, ওকে বাহবা দেবে। কিন্তু বাহবা তো দূরের কথা, অঞ্জনের মাথার স্থিরতা নিয়ে সন্দেহ শুরু করল ওরা। কেউ ওর কথা বিশ্বাস করল না। সবাই ওকে নিয়ে হাসাহাসি করল। সারা স্কুলের সবাইকে জানিয়ে দিল, অঞ্জন পাগল।
গপ্পি অঞ্জন’ নামও দিয়ে ফেলল কেউ কেউ। ইস্, ভূতুড়ে রক্ত সত্যি সত্যি আছে যদি ওদের কাছে প্রমাণ করতে পারতাম! বিষণœ হয়ে ভাবছে ও। দেখাতে পারতাম ওই ভয়ঙ্কর রক্তের কাণ্ডকারখানা! কিন্তু পাবে কোথায় এখন। দাদুর বাড়িতে, ওর চোখের সামনে ভোজবাজির মত উধাও হয়ে গিয়েছিল ওই রক্ত, স্রেফ বাতাসে মিলিয়ে গিয়েছিল। সেটাও আরেক তাজ্জব ব্যাপার! এত এত রক্তের কিছুমাত্র আর অবশিষ্ট ছিল না। একটা বিন্দুও না। ঘণ্টা বাজল। লাফিয়ে উঠে দাঁড়িযে হাসাহাসি, হই-চই করে কথা বলতে বলতে দরজার দিকে ছুটল সবাই। অঞ্জন জানে, বেশির ভাগ ছেলেমেয়েই এ মুহূর্তে ওকে নিয়ে হাসাহাসি করছে। সেসব গায়ে না মেখে আস্তে করে নিজের স্কুল-ব্যাগটা তুলে নিল ও। ধীরে ধীরে হাঁটতে লাগল দরজার দিকে। ‘অঞ্জন, জলদি আসবে,’ পিছনে ডেস্কের কাছ থেকে ডেকে বললেন হারুণ সার। ‘তাড়াতাড়ি। গুটুল তোমার জন্যে অপেক্ষা করবে।’ চাপা স্বরে গজগজ করে দরজা দিয়ে বেরিয়ে এল অঞ্জন। লম্বা বারান্দা ধরে এগোল। ওই বোকা টিচারটা যদি এতই ভালবাসেন হাঁদা গিনিপিগটাকে, তাহলে নিজেই ওর খাঁচা পরিষ্কার করেন না কেন? ভেবে তেতো হয়ে গেল অঞ্জনের মন। এক জায়গায় জটলা করছে কয়েকটা ছেলেমেয়ে। অঞ্জন ওদের পাশ কাটানোর সময় হেসে উঠল ওরা, এ ওর গায়ে গুঁতো মারল, ঠেলা দিল। ওকেই কি ব্যঙ্গ করছে ওরা? বুঝতে পারল না অঞ্জন। তাড়াতাড়ি যেতে বলেছেন হারুণ সার। লকারের দিকে ছুটতে আরম্ভ করল ও। ঠিক এই সময় শক্ত কী যেন পায়ে বাধল। পা দুটো সরে গেল মেঝে থেকে। প্রায় উড়ে গিয়ে মুখ নিচু করে সিমেন্টের শক্ত মেঝেতে পড়ল ও। ‘অ্যাই!’ রাগে চিৎকার করে উঠল অঞ্জন।
মুখ ফিরিয়ে তাকিয়ে দেখে বিশালদেহী, পেশীবহুল একটা ছেলে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। ছেলেটার নাম ইমন। স্কুলের ছেলেমেয়েরা নাম দিয়েছে ডাকাতে ইমন। ছেলেটা অঞ্জনের বয়েসী, কিন্তু শরীর দেখে মনে হয় বিশ বছরের জোয়ান। কুস্তিগীরের মত শরীর। গায়ে প্রচণ্ড শক্তি। কুটিলতায় ছাড়িয়ে গেছে স্কুলের সমস্ত ছেলেমেয়েকে। ডাকাতে বলা হলেও চেহারাটা কিন্তু খারাপ না ছেলেটার। বরং অনেকের চেয়ে অনেক ভাল। রাগ লাগে অঞ্জনের। হিংসেও হয়। কারণ ওর মত টিংটিঙে নয় ইমন। তা ছাড়া মাথাভর্তি ঝাঁকড়া চুল, বড় বড় চোখ। স্কুলের যে খেলাতেই অংশ নেয়, ফার্স্ট হয়। আর তাতে করে যত দুষ্টই হোক, শিক্ষকদের সুনজরে থাকে। নামের আগে ‘ডাকাতে ’ শব্দটা জুড়ে দেয়াতে মোটেও দুঃখিত নয় ইমন। বরং গর্বিত। বলে, বিশেষত্ব আছে। স্কুলে দাম্ভিক ভঙ্গিতে চলেফিরে বেড়ায় ও, যাকে ইচ্ছে যখন খুশি পেটায়, হেনস্থা করে। ভয়ে প্রতিবাদ জানায় না কেউ। মুখ খোলারও সাহস করে না। খেলার মাঠে ইমনের সঙ্গে অঞ্জনের প্রথম দেখা। ওর সঙ্গে বন্ধুত্ব করার ইচ্ছেতে ভূতুড়ে রক্তের গল্প শুনিয়ে ওকে চমকে দিতে চেয়েছিল অঞ্জন। গল্পটা পছন্দ হয়নি ইমনের। কঠিন দৃষ্টিতে দীর্ঘ সময় ধরে তাকিয়ে থেকেছে অঞ্জনের দিকে। শক্ত হয়ে উঠেছে চোয়াল। তারপর দাঁতের ফাঁক দিয়ে হিসহিস করে বলেছে, ‘বেকুব পেয়েছ আমাকে, না? তোমার গাঁজা বিশ্বাস করব? মফস্বলের ভূত! এটা নোয়াখালির গ্রাম না, ঢাকা শহর, বুঝলে, হাঁদা?’ গায়ে পড়ে অঞ্জনের সঙ্গে ঝগড়া বাধাল ও। অনেক মারল। এরপর থেকে ওকে এড়িয়ে চলে অঞ্জন। পারতপক্ষে ওর সামনে পড়তে চায় না। এখন মেঝেতে উপুড় হয়ে পড়ে থেকে মুখ ঘুরিয়ে তাকাল।
প্রথমে রেগে উঠলেও ইমনের চোখে চোখ পড়তে সুর নরম করে বলল, ‘এই, তুমি আমার পায়ে লাথি মারলে কেন?’ খিকখিক করে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে অঞ্জনকে যেন উড়িয়ে দিল ইমন, ‘অ্যাক্সিডেন্ট!’ মাটি থেকে ওঠা নিরাপদ, না পড়ে থাকাটা নিরাপদ-বুঝতে পারছে না অঞ্জন। সিদ্ধান্ত নেয়া কঠিন। উঠে দাঁড়ালে যদি ঘুসি মারে? পড়ে থাকলেও বাঁচতে পারবে না। পা দিয়ে মাড়াবে ওকে ইমন। তবে সিদ্ধান্তটা ইমনই নিল। একটানে মাটি থেকে অঞ্জনকে তুলে দাঁড় করাল। ‘আমাকে ছেড়ে দাও, ইমন!’ অঞ্জন বলল। ‘আমি তো তোমার কোন ক্ষতি করিনি।’ ইমনের চোখের তারায় মিটিমিটি হাসি। ‘ঠিকই বলেছ, অঞ্জন। তোমার পায়ে লাথি মারাটা ঠিক হয়নি আমার।’ ‘হ্যাঁ,’ টেনেটুনে গায়ের কাপড় ঠিক করতে লাগল অঞ্জন। ‘আসলেই ঠিক হয়নি।’ ‘তাহলে তুমি বদলা নাও,’ প্রস্তাব দিল ইমন। ‘অ্যাঁ!’ হাঁ হয়ে গেল অঞ্জন। নিজের চওড়া বুকটা সামনে চিতিয়ে দিয়ে ইমন বলল, ‘ঘুসি মারো আমাকে। বুকে মারতে না চাইলে পেটে মারো। নাও, আমি নিজেই তোমাকে মারতে দিলাম।’ ‘না না, কী বলো!’ অঞ্জন অবাক। পিছনে তাকিয়ে দেখে ওকে ঘিরে যেন দেয়াল তুলে দাঁড়িয়ে গেছে কয়েকটা ছেলেমেয়ে। মজা দেখছে। ‘আরে মারো না,’ সামনে এগিয়ে এল ইমন। ‘আমার পেটে ঘুসি মারো। গায়ের জোরে মারো। তোমার পায়ে লাথি মারার শোধ নাও।’ ইমনের মুখের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে অঞ্জন। ‘সত্যি বলছ?’ মাথা ঝাঁকাল ইমন। বুকটা আরও চিতিয়ে দিল। ‘যত জোরে পারো, মারো, বললামই তো। কিচ্ছু করব না। কসম।’ তবু দ্বিধা করছে অঞ্জন। ভাবছে, ইমনকে পিটানোর এ রকম সুযোগ আর পাওয়া যাবে না। আশেপাশে অনেক ছেলেমেয়ে জমে গেছে। তাকিয়ে আছে ওর দিকে। যদি জোরে মারতে পারে, ইমনকে ব্যথা দিতে পারে, সবাই সম্মানের চোখে দেখতে আরম্ভ করবে অঞ্জনকে। হিরো হয়ে যাবে ও। সবাই বলবে, জানো, ডাকাতে ইমনকে ধরে পিটিয়েছে সেই নতুন আসা ছেলেটা। ঘুসি তুলল অঞ্জন। হাসি ছড়িয়ে পড়েছে ইমনের মুখে। ওর উদ্দেশ্যটা বুঝতে পারছে না অঞ্জন। ‘মুঠোটা কিন্তু খারাপ না তোমার।’ অঞ্জনকে উৎসাহ জোগাচ্ছে ইমন। ‘ওই মুঠোর ঘুসি খেলে বাপের নাম ভুলে যাবে যে কেউ।
ভয় পাওয়ার ভান করল ইমন। মুখে হাসি। সবাই হেসে উঠল। ‘মারো না। দেরি করছ কেন?’ বড় করে দম নিয়ে ফুসফুসে আটকে রাখল ইমন। শক্ত করে ফেলেছে পেটের চামড়া। হাত ঘুরিয়ে গায়ের জোরে ঘুসি মারল অঞ্জন। থ্যাক করে উঠল ইমনের পেটে লেগে। অঞ্জনের মনে হলো, যেন শক্ত রবারের গায়ে বাধা পেয়ে ফিরে এল হাত। তীক্ষ¦ ব্যথা ছড়িয়ে পড়ল বাহুতে। ইমনের মুখে শ্লেষের হাসি। ‘অ্যাই, অ্যাই, কী হচ্ছে!’ পিছন থেকে শোনা গেল রাগত কণ্ঠ। চমকে গেল ইমন। চরকির মত পাক খেয়ে ঘুরে তাকাল। জ্বলন্ত চোখে ওদের দিকে তাকিয়ে আছেন হারুণ সার। ধমকে উঠলেন, ‘মারামারি করছ কেন!’ ছুটে এলেন তিনি। দুজনের মাঝে বাধা হয়ে দাঁড়ালেন। হাঁপাতে হাঁপাতে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ইমন, অঞ্জন তোমাকে মারল কেন?’ চার মুহূর্তে মুখটাকে কাচুমাচু করে ফেলল ইমন। ‘দেখুন না, সার, আমি এখান দিয়ে যাচ্ছিলাম, শুধু শুধুই আমাকে ডেকে দাঁড় করিয়ে ঘুসি মারল। আমি কিচ্ছু করিনি, সার।’ পেট ডলতে ডলতে গুঙিয়ে উঠল ইমন। ‘উহ্, ব্যথা করছে! এত্ত জোরে মেরেছে!’ কুতকুতে চোখ দুটো সরু করে অঞ্জনের দিকে তাকালেন হারুণ সার। রাগে লাল হয়ে গেছে আবার গোল মুখটা। শীতলকণ্ঠে বললেন, ‘অঞ্জন, সমস্ত ঘটনাটাই আমি দেখেছি। তোমাকে আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না।’ ‘কিন্তু, সারঃ’ বলতে গেল অঞ্জন। শুনলেন না টিচার। হাত নেড়ে থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘আমি তোমাকে যে কাজ দিয়েছি, তার জন্যে যদি রাগ হয়ে থাকে তোমার, সেই ঝাল তুমি অন্য ছেলেদের ওপর ঝাড়তে পারো না।’ পেট ডলেই চলেছে ইমন। ব্যথা পাওয়ার ভঙ্গিতে মুখ বিকৃত করে বলল, ‘পেটের ভিতরে জখমই করে ফেলল কি না খোদাই জানে!’ ‘ডাক্তারের কাছে যেতে চাও?’ হারুণ সার জিজ্ঞেস করলেন। মাথা নাড়ল ইমন। মুখ স্বাভাবিক রাখতেও যেন কষ্ট হচ্ছে। ‘না না, লাগবে না। বিশ্রাম নিলেই ঠিক হয়ে যাবে।’ টলতে টলতে সরে গেল ও। কী ভণ্ড! আবার তেতো হয়ে গেল অঞ্জনের মন। ইমনের ফাঁদে পা দিয়ে বোকামির জন্য মনে মনে গালাগাল করতে লাগল নিজেকে। হারুণ সার যে দাঁড়িয়ে ছিলেন, দেখছিলেন ওদের, ইমন কি সেটা দেখেছিল? সম্ভবত। নইলে এই নাটকটা করত না।
যাও, গুটুলকে দেখোগে,’ ভুরু কুঁচকে অঞ্জনকে আদেশ দিলেন হারুণ সার। ‘আর নিজেকে ভাল করার চেষ্টা করো, অঞ্জন। আমি তোমার ওপর কড়া নজর রাখব।’ আপনমনে বিড়বিড় করতে করতে ক্লাসরুমে ফিরে এল অঞ্জন। জানালা দিয়ে রোদ আসছে। জোরাল বাতাসে টিচারের ডেস্কের কাছের জানালাটার পাল্লাটা খটখট করছে। প্রচণ্ড রাগে পেটের মধ্যে যেন কেমন করছে অঞ্জনের। শূন্য ক্লাসরুমে প্রাণী বলতে শুধু গুটুল। খাঁচাটার দিকে এগোল ও। নাক কুঁচকে ফেলল প্রাণীটা। বিচিত্র ভঙ্গিতে বাতাস শুঁকে যেন স্বাগত জানাল অঞ্জনকে। গুটুলকে এত ভালবাসেন কেন হারুণ সার, ভেবে পায় না অঞ্জন। খাঁচার ভিতরের কুৎসিত প্রাণীটার দিকে তাকিয়ে আছে ও। থেকে থেকে নাক কুঁচকানো, এক জায়গায় ভাঁড়ের মত ঘুরতে থাকা, ঠেলে বেরোনো ধারাল দাঁত, কোনটাই দেখার মত কিছু না। ছোট ছোট কুতকুতে চোখ মেলে অঞ্জনের দিকে তাকাল গিনিপিগটা। হেসে ফেলল অঞ্জন। হারুণ সারের চোখের সঙ্গে প্রচুর মিল প্রাণীটার। এ কারণেই বোধহয় ওটাকে এত ভালবাসেন তিনি। ‘এই হাঁদা গিনিপিগ,’ অঞ্জন বলল, ‘তোর নাম কুতকুতে না রেখে গুটুল রাখল কেন রে?’ ওপর দিকে নাক তুলে বিচিত্র ভঙ্গিতে কাঁপাতে কাঁপাতে যেন ওর কথার জবাব দিতে চাইল গিনিপিগটা। ‘থাক, থাক, আর নাক কাঁপাতে হবে না, ভূমা ইঁদুর কোথাকার!’ ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে খাঁচার নীচে ঢোকানো ট্রে-টা টেনে বের করল অঞ্জন। দুর্গন্ধ সইতে না পেরে দম বন্ধ করে ফেলল। ‘নোংরা ইঁদুর,’ বিড়বিড় করে বলল ও, ‘নিজের ঘর নিজে পরিষ্কার করা কবে শিখবি তুই?’ ট্রেতে বিছানো পুরানো খবরের কাগজটা কুচি কুচি করে কেটেছে গুটুল। সেগুলো একটা ময়লার বাক্সে ঢেলে দিয়ে ট্রের ওপর নতুন কাগজ বিছাল অঞ্জন। আবার যখন খাঁচার ভিতরে ট্রে-টা ঠেলে দিচ্ছে ও, কুতকুতে চোখে গভীর আগ্রহ নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইল গিনিপিগটা।
খাঁচা থেকে পানির বাটিটা বের করে পানির বোতল থেকে নতুন পানি ভরল অঞ্জন। ‘কী রে, হাঁদা ইঁদুর, গম খাবি? খিদে পেয়েছে?’ কাজ শেষ হয়ে এসেছে, তাই মনের ভার অনেকটাই কেটে গেছে অঞ্জনের। খাবারের বাটিটা পরিষ্কার করে সেটা নিয়ে রওনা হলো ঘরের অন্যপ্রান্তে। ওখানে একটা আলমারি রাখা। বিজ্ঞান সারের সম্পত্তি। গিনিপিগের খাবার ছাড়াও কিছু প্রয়োজনীয় টুকটাকি জিনিস রাখেন তাতে হারুণ সার। কিছু গম বের করে বাটিতে রেখে ওখান থেকে চেঁচিয়ে বলল অঞ্জন, ‘সারাক্ষণ তো কাটিস খবরের কাগজ, গম তোর কাছে খাসির বিরানি, তাই না রে, গুটুল?’ বাটি হাতে ঘুরে দাঁড়াল ও। খাঁচার দিকে এগোল। অর্ধেক পথ এগিয়ে খাঁচার দিকে চোখ পড়তেই থমকে দাঁড়াল। অস্ফুট শব্দ করে উঠল। হাঁ হয়ে খুলে রয়েছে খাঁচার দরজা। ভিতরে নেই গিনিপিগটা। পাঁচ ছোট্ট একটা চিৎকার আপনাআপনি বেরিয়ে গেল অঞ্জনের মুখ থেকে। শূন্য খাঁচাটার দিকে তাকিয়ে যেন দম আটকে আসছে ওর। সারাঘরে দ্রুত ঘুরে বেড়াচ্ছে ওর দৃষ্টি।
গুটুল! গুটুল!’ ভীতকণ্ঠে ডাকতে লাগল অঞ্জন। আসে না কেন? আতঙ্কিত হয়ে চরকির মত পাক খেয়ে ঘুরছে। নিজের নামও জানে না নাকি হাঁদাটা! বারান্দায় পায়ের শব্দ শোনা গেল। হারুণ সার? সর্বনাশ! খোদা, হারুণ সার না হোক! গুটুলকে ধরে আবার খাঁচায় ভরার আগে যেন ফিরে না আসেন তিনি! হারুণ সারের খুব প্রিয় প্রাণী গুটুল। ওটার কিছু হলে সার ওকে ছাড়বেন না। এর জন্য হয়তো সারাটা বছর-না না, সারাটা জীবন নির্যাতিত হতে হবে আমাকে-ভাবছে অঞ্জন। ঘরের মাঝখানে পাথরের মূর্তি হয়ে গেছে যেন ও। কান পেতে শুনছে। বারান্দা দিয়ে পার হয়ে গেল পায়ের শব্দ। আবার দম নিতে শুরু করল অঞ্জন। ‘গুটুল! কোথায় তুই? গুটুল!’ কাঁপা গলায় ডাকল ও। ‘তোর জন্যে তাজা গম এনেছি। খেয়ে দেখ, কী মজা!’ রোমশ, বাদামী সাদা প্রাণীটাকে চোখে পড়ল ওর। ব্ল্যাকবোর্ডের নীচে রাখা চকের বাক্সের ডালার ওপর বসে আছে। ‘অস্তে! সাবধানে!’ ফিসফিস করে নিজেকে বলল অঞ্জন। পা টিপে টিপে এগোল। ব্যস্ত ভঙ্গিতে কী যেন চিবোচ্ছে গুটুল। ভাল করে দেখে বুঝল অঞ্জন, সাদা চক কাটছে গিনিপিগটা। নিঃশব্দে কাছে চলে এল অঞ্জন। ‘তোর জন্যে গম এনেছি, গুটুল,’ ফিসফিস করে বলল ও। ‘অকারণে চক খাচ্ছিস। গম অনেক বেশি মজা।’ সামনের দুই থাবায় শক্ত করে চকটাকে ধরে ঘুড়ির নাটাইয়ের মত ঘোরাচ্ছে আর কামড়াচ্ছে গুটুল। কাছে এগোল অঞ্জন। আরও কাছে। ‘দেখ। গম।’ প্লাস্টিকের বাটিটা গিনিপিগটার দিকে বাড়িয়ে দিল ও। চোখ তুলল না গুটুল। আরও কাছে এগোল অঞ্জন। আরেকটু কাছে। গিনিপিগটাকে ধরতে ঝাঁপ দিল। এবং মিস করল! চকটা থাবা থেকে ফেলে লাফ দিয়ে সরে গেল গিনিপিগটা। থাবা দিয়ে ধরতে গেল অঞ্জন।
কিন্তু বাতাসে খামচি দিল শুধু আঙুলগুলো। হতাশ গোঙানি বেরোল অঞ্জনের মুখ থেকে। ছুটে গিয়ে হারুণ সারের টেবিলের নীচে ঢুকে পড়ল গিনিপিগটা। ‘পালাবি কোথায়, হাবুলচন্দ্র!’ চেঁচিয়ে বলল অঞ্জন। হাঁটু গেড়ে বসে টেবিলের নীচে উঁকি দিল। অন্ধকার থেকে ওর দিকে তাকিয়ে আছে গিনিপিগটা। জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। দ্রুত ওঠানামা করতে দেখল বুক আর পেটের একপাশ। ‘ভয় পাবি না,’ মোলায়েম মিহি স্বরে বলল অঞ্জন। ‘আমি তোকে মারব না, আস্তে করে নিয়ে গিয়ে খাঁচায় রেখে দেব। ওখানেই ভাল থাকবি তুই।’ হামাগুড়ি দিয়ে টেবিলের নীচে ঢুকতে শুরু করল ও। ওর দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে গিনিপিগটা। জোরে জোরে হাঁপাচ্ছে। নড়ছে না। কিন্তু যেই হাত বাড়াল অঞ্জন, অমনি লাফিয়ে সরে গেল। টেবিলের নীচ থেকে বেরিয়ে চলে গেল। লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল অঞ্জন। ‘এই গুটুল, তোর সমস্যাটা কী বল তো? আমি কি তোর সঙ্গে খেলা করছি ভাবছিস?’ কিন্তু অঞ্জন জানে, এটা খেলা নয়। গিনিপিগটাকে ধরে যদি খাঁচায় ফিরিয়ে নিতে না পারে হারুণ সার ওর সর্বনাশ করে ছাড়বেন। এই স্কুল থেকে তো বের করাবেনই, অন্য কোনও স্কুলে যাতে ভর্তি হতে না পারে সেই ব্যবস্থা করতেও পিছপা হবেন না। শান্ত হও, অঞ্জন, নিজেকে বলল ও। আতঙ্কিত হয়ো না। লম্বা দম নিয়ে ফুসফুস ভরল। তারপর দেখল গিনিপিগটা কোথায় আছে। খোলা জানালার চৌকাঠে উঠে পড়েছে ওটা। আতঙ্কিত হয়ো না, বার বার নিজেকে বুঝিয়েও আতঙ্কিত না হয়ে পারল না অঞ্জন। গিনিপিগটাকে ডাকার চেষ্টা করল। স্বর বেরোল না গলা দিয়ে। ঢোক গিলল। সাবধানে এক পা এক পা করে এগিয়ে চলল জানালার দিকে। ‘এদিকে আয়, গুটুল,’ ফিসফিস করে বলল ও, ‘দোহাই লাগে তোর, আয় এখানে!’ কাছে চলে এসেছে। আরও কাছে। হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে গিনিপিগটাকে। আরেকটু কাছে।
নড়িস না, গুটুল! নড়িস না!’ আস্তে করে হাতটা বাড়াল ও। ধীরে ধীরে সামনে এগিয়ে নিয়ে গেল। দীর্ঘ একটা মুহূর্ত কুতকুতে কালো চোখ দিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইল গিনিপিগটা। তারপর লাফিয়ে পড়ল জানালার বাইরে। ছয় একটা সেকেন্ড দাঁড়িয়ে রইল অঞ্জন। তারপর সে-ও লাফ দিল জানালার বাইরে। ঘরটা নীচতলায় হলেও বেশ উঁচু। একটা ঝোপের মধ্যে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। হাঁচড়ে-পাঁচড়ে উঠে দাঁড়াল আবার। ঘাস মাড়িয়ে কিছুদূর এগোল। পাতাবাহারের লম্বা বেড়া চলে গেছে অনেক দূর পর্যন্ত। গাছের গোড়ার দিকে ওর চোখ। গুটুলকে খুঁজছে। ‘গুটুল, কোথায় তুই? কোন গাছের গোড়ায় লুকিয়েছিস?’ বসে পড়ে নিচু হয়ে উঁকি দিল ভাল করে দেখার জন্য। প্রায় পুরো স্কুল বাড়িটাকেই ঘিরে রেখেছে পাতাবাহারের বেড়া। গুটুল সারাজীবন এখানে লুকিয়ে থাকলেও খুঁজে বের করা কঠিন হবে। যদি ওকে খুঁজে না পাই, তিক্তকণ্ঠে নিজেকে বলল অঞ্জন, আমাকেও ওই বেড়ার আড়ালে লুকিয়ে থাকতে হবে চিরকাল! ডানদিকে খেলার মাঠ। সেখান থেকে হই-চই কানে আসছে। ক্রিকেট খেলছে কয়েকটা ছেলে। খেলা দেখছে অনেকগুলো ছেলেমেয়ে। মহা আনন্দে আছে সবাই। অথচ ও! দীর্ঘশ্বাসটা আপনাআপনি বেরিয়ে এল অঞ্জনের বুকের গভীর থেকে। বসে থেকেই খেলার মাঠের দিকে ঘুরে তাকাল ও। বাদামী রঙের একটা জিনিস ঘাসের ওপর দিয়ে দৌড়ে চলেছে খেলার মাঠের দিকে। গুটুল! লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল অঞ্জন। এবার আর ওই শয়তান গিনিপিগটাকে যেতে দেবে না কোনমতেই! দরকার হয় ওটার পিঠে ঝাঁপ দেব। থেঁতলে গেলে যাক, তবু ধরব! মনে মনে দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রাণীটার পিছনে ছুটল ও।
থেঁতলে চ্যাপ্টা হয়ে যাওয়া গিনিপিগের দেহটা কল্পনা করে মুখ বাঁকাল। লাফিয়ে লাফিয়ে ঘাসের ওপর দিয়ে খেলার মাঠের দিকে ছুটে চলেছে গুটুল। সাইকেলে চেপে দুটো মেয়েকে আসতে দেখে চেঁচিয়ে উঠল অঞ্জন, ‘না না!’ হাসাহাসি করে কথা বলতে বলতে আসছে ওরা। গুটুলকে দেখেনি। যে কোন মুহূর্তে চাপা পড়বে গিনিপিগটা। ভাবনাটা যেন কুঁকড়ে দিল অঞ্জনকে। চোখ বুজে ফেলল। চাকার নীচে পড়া গুটুলের আর্ত চিৎকার শোনার অপেক্ষা করছে। কিন্তু পাশ দিয়ে মসৃণ গতিতে সাইকেল চালিয়ে চলে গেলে মেয়ে দুটো। চোখ মেলল আবার অঞ্জন। গিনিপিগটাকে দেখল। অক্ষত অবস্থায় ছুটে যাচ্ছে খেলার মাঠের দিকে। ‘গুটুল, থাম! জলদি আয়!’ রাগে চেঁচিয়ে উঠল অঞ্জন। গতি আরও বেড়ে গেল গিনিপিগটার। খেলার মাঠে ঢুকে পড়ল। আঁতকে উঠল অঞ্জন। একটা ক্রিকেট বল এসে গিনিপিগটার গায়ে লাগলেঃকী ঘটবে, আর ভাবতে চাইল না ও। খেলা থামিয়ে তাকিয়ে রইল কয়েকটা ছেলে। ‘ওকে থামাও! ধরো ওকে!’ গিনিপিগটাকে দেখিয়ে মরিয়া হয়ে ছেলেগুলোকে অনুরোধ করল অঞ্জন। হেসে উঠল খেলোয়াড়-দর্শকদের অনেকে। টিটকারি দিয়ে অঞ্জনকে বলল একটা ছেলে, ‘কীভাবে ধরতে হয় জানো না বুঝি? গম, গম বলে চেঁচাও। দাঁড়িয়ে যাবে।’ হা-হা করে হাসল আরেকটা ছেলে। ‘আহা, আমাদের গিনিপিগতাড়ুয়া!’ এদেরকে অনুরোধ করে কোনই লাভ নেই। ‘
No comments:
Post a Comment