ইউনিভার্সিটির মেয়ে
জীবন পাতার খাতায়, অথবা হৃদয়ে খুদাই করে কত নাম লেখা থাকে কে জানে? যখন নিসংগতা কুড়ে কুড়ে খেতে থাকে, তখন সেসব নাম, অথবা মিষ্টি মুখ গুলো বুঝি নিজের অজান্তেই চোখের সামনে ভেসে আসে।তখনও ইউনিভার্সিটিতে ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি। সেশন জটটা তখনও ছিলো। ধরতে গেলে অনেকটা ফার্স্ট ইয়ারের ক্লাশ শুরু হতে না হতেই নুতন ব্যাচটা এসে ঢুকেছিলো। চঞ্চল ছাত্রছাত্রীদের আনাগুনা ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসটাকে আবারো নুতন করেই জমিয়ে তুলছিলো।
গ্যালারীতে ক্লাশ। ক্লাশ শুরু হতে তখনও অনেক সময় বাকী। আগের পিরিয়ডে কোন ক্লাশ ছিলো না বলেই, একটু আগে ভাগেই গ্যালারীর সামনে বারান্দায় দাঁড়িয়ে, ক্লাশের সময়টা শুরু হবার অপেক্ষাতেই ছিলাম। শুধু আমিই নই, এক ঝাক ছাত্র, বারান্দার গ্রীলে পাছা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে ক্লাশের অপেক্ষাতেই ছিলো। ঠিক তখনই বারান্দা ধরে চঞ্চলা হরিণীর মতো যে মেয়েটিকে ছুটতে দেখেছিলাম, তারা দিকেই চোখ দুটি থেমে গিয়েছিলো। সুন্দরের চাইতেও, চেহারায় আভিজাত্যই যেনো বেশী। দীর্ঘাঙ্গী, উঁচু বুক, সাপের মতোই সরু কোমর, ভারী পাছাটা দুলিয়ে দুলিয়ে চোখের সামনে দিয়ে সাই সাই করে ছুটে গেলো। আমার হৃদয়টা দুলিয়ে দিয়েছিলো, প্রবল ঝড়ের তাণ্ডবে। ক্লাশের সময় হয়ে গিয়েছিলো। ক্লাশে ঢুকতে মন চাইলোনা। সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে আমি এগুতে থাকলাম বারান্দা ধরে ও প্রান্তে।
একটু তাড়া করেই ছুটাছিলাম। পাছে মেয়েটি দৃষ্টির আঁড়ালে চলে যায়। বারান্দার ও প্রান্তে ক্যামিক্যাল ইঞ্জইনীয়ারিং ডিপার্টমেন্ট। বারান্দার রেলিংয়েই বসা দেখলাম মেয়েটিকে। আমার পা দুটি হঠাৎই থেমে গেলো। মেয়েটিও এক নজর আমার চোখে চোখে তাঁকালো। আমি চোখে চোখে কথা বলতে চাইলাম। অথচ, মেয়েটি চোখ সরিয়ে নিলো।
আমার পা চলতে চাইলো না। তারপরও পা চালালাম ধীর পায়ে। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠলাম ঠিকই, মনটা কিছুতেই মানতে চাইলো না। আরেক নজর মেয়েটিকে খুবই দেখতে ইচ্ছে করলো। আমি আবারো সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামলাম। মেয়েটির দৃষ্টি আকর্ষন করারই চেষ্টা করলাম। মেয়েটি আবারো আমার চোখে চোখ রাখলো, তবে চোখ সরালো না। এক প্রকার সন্দেহজনক দৃষ্টি মেলে দীর্ঘক্ষণই আমার দিকে তাঁকিয়ে রইলো। আমার হৃদয়টা আনন্দে ভরে উঠলো। আমিও চোখে চোখে তাঁকিয়ে থাকতে চাইলাম। কেনো যেনো চক্ষু লজ্জাই আমাকে কাতর করলো। আমি মেয়েটির পাশ কেটে ধীর পায়েই এগুতে থাকলাম। অপরূপ আভিজাত্যে ভরা একটা চেহারা যেনো হৃদয়ের সাথে গেথে রইলো। কি নাম মেয়েটির? এমন একটি মেয়েকে যদি জীবন সংগিনী করে পাই, তাহলে বোধ হয়, জীবনে আর কিছুই চাইনা।
আমার পা চলেনা। আবারো মেয়েটিকে দেখতে মন চাইলো। আমি পেছন ফিরে তাঁকালাম। অথচ, বারান্দার রেলিং এ কাউকেই চোখে পরলো না। কোথায় কোনদিকে গেলো কিছুই বুঝতে পারলাম না। বুকটা হু হু করে উঠতে থাকলো হঠাৎই করেই। মনে হতে থাকলো, এমন একটি মেয়ে এই জীবনে কাছে না পেলে, জীবনটাই বুঝি অর্থহীন। আমি যেনো নুতন করেই মেয়েটির প্রেমে পরে গিয়েছিলাম।
খোঁজ খবরটা কৌশল করেই জেনে নিয়েছিলাম। নাম রুমি, ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তি হয়েছে মাত্র। ক্যামিক্যাল ইঞ্জিনীয়ারিংয়ে। আমি পাগলের মতো খোঁজে বেড়াতে থাকলাম মেয়েটিকে ক্যামিক্যাল ইঞ্জইনিয়ারীং ডিপার্টমেন্টের আনাচে কানাচে। কোথাও চোখে পরলো না। নুতন ব্যাচের ফার্স্ট ইয়ারের সব মেয়েকেই দেখি, শুধু মাত্র রুমিকেই চোখে পরে না।
সেদিন দুপুর তিনটার দিকেই ক্লাশ শেষ হয়েছিলো। অনেকটা ক্লান্ত দেহেই মেসে ফিরে চলছিলাম। আগে পিছে অন্য সব ক্লাশ মেইটারাও আছে। সবাই রিক্সা কিংবা বাস এর জন্যেই ছুটাছুটি করছিলো।
অপেক্ষা আমার ভালো লাগে না। রিক্সা চড়ে অযথা পয়সা নষ্ট করার মতো বিলাসীতাও করি না। সময় মতো বাস না পেলে, হেঁটেই রওনা হয়ে পরি মেসের পথে। দু কিলোমিটার পথ, খানিক কষ্ট হয়, তারপরও অভ্যাস হয়ে গেছে।
আমি হেঁটে হেঁটেই মেসে ফিরছিলাম। হঠাৎই পার্কের দিকে চোখ পরেছিলো। অবাক হয়ে দেখলাম রুমিকে। একটা আবুল মার্কা চেহারার ছেলের পাশে রুমি পার্কে গাছের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে। আমার মনটা তৎক্ষণাত ক্ষত বিক্ষত হতে থাকলো। আমার পা চলতে চাইলো না। মনটা শুধু আর্ত চিৎকার করতে থাকলো, না, না, রুমি শুধু আমার! ওরকম কুৎসিত চেহারার কোন ছেলের সাথে রুমির কোন সম্পর্ক থাকতে পারে না। আমি পার্কের পাশেই অর্থহীন ভাবে বসে পরলাম। হাতের নোট খতাটা ছুড়ে ফেলে সবুজ ঘাসের উপরই চিৎ হয়ে শুয়ে পরলাম। এক নজর তাঁকালামও রুমির দিকে। দেখলাম, রুমি বাম হাতটা মাথার পেছনে ঠেকিয়ে, এক দৃষ্টিতেই আমার দিকে তাঁকিয়ে আছে। পাশের ছেলেটা আগ্রহ করে অনেক কিছুই বলছে বোধ হয়। রুমির মনযোগটা সেদিকে ছিলো না। সে আমার দিকেই তীক্ষ্ম চোখে তাঁকিয়ে থাকলো।
এত সুন্দর চোখ আর এত সুন্দর ঠোট বোধ হয় এই জীবনে খুব কমই দেখেছি। ঝর ঝরে রেশমী চুলগুলোও খনিকটা হাওয়ায় উড়ছিলো। আমিও সবুজ ঘাসের উপর কাৎ হয়ে শুয়ে, রুমির দিকে এক দৃষ্টিতেই তাঁকিয়ে রইলাম। বুঝাতে চাইলাম, আমি তোমাকে ভালোবাসি রুমি। আমি তোমাকে প্রথম দৃষ্টিতেই ভালোবেসে ফেলেছি।
পাশের ছেলেটিও রুমির দৃষ্টি আকর্ষন করার চেষ্টা করছিলো। রুমি শুধু মাথা নাড়ছিলো। আর জোড় করেই যেনো হাসছিলো। কিন্তু চোখ দুটি ঠিক আমার দিকেই করে রেখেছিলো। আমার মনটা শুধু উদাস হতে চলছিলো।
রুমির ভাব সাব দেখে মনে হলো, ছেলেটির সাথে তেমন কোন গভীর সম্পর্ক নেই। ছেলেটিও সবে মাত্র রুমির প্রেমে পরে যথাসাধ্য চেষ্টা করছে রুমিকে প্রেম নিবেদন করতে। আমি চোখের ভাষাতেই বলতে চাইলাম, ওকে ভালোবেসো না রুমি। তুমি আমার। তোমাকে আমি রাজ্যের সুখ উপহার দেবো।
রুমির অমনোযোগীতা বোধ হয় ছেলেটিও অনুমান করতে পেরেছিলো। ছেলেটি ইশারা করলো অন্যত্র যেতে। রুমি যেনো অনেকটা বাধ্যের মতোই ছেলেটির পাশ ধরে এগুলো। রাস্তার মোড়টায় গিয়ে, ছেলেটি একটা রিক্সা ডাকলো। দাম দর না করেই উঠে বসলো রিক্সাতে। রুমিও তার ভারী পাছাটা তুলে ছেলেটির পাশেই রিক্সায় উঠলো। সে দৃশ্য দেখে আমার মনটা আবারো ক্ষত বিক্ষত হয়ে উঠতে থাকলো। ভেতর মনটা চিৎকার করে বলতে থাকলো, না রুমি না, ও ছেলের সাথে যেও না। তুমি আমার, শুধু আমার।
রিক্সাটা কখন কোনদিকে হারিয়ে গেলো বুঝলাম না। আমি অলস পায়ে ফিরতে থাকি মেসে।দুদিন পরই বাংলা নব বর্ষ। খুবই ইচ্ছে করলো, এমন একটি দিনে রুমিকে কিছু উপহার করতে। এখনো পরিচয়ও তো হলো না। কি উপহার করা যায়? একখানি বই?
আমি তৎকালে নামকরা লেখক এর একখানি গল্পের বই খুব শখ করেই কিনলাম রুমির জন্যে। উপহার এর কাগজে মুড়িয়ে রুমিকেই খোঁজছিলাম। ক্যামিক্যাল ইঞ্জিনীয়ারিং ডিপার্টমেন্টের শেষ প্রান্তেই রুমিকে দেখলাম একাকী বসে। আমি খুব রোমাঞ্চতা ভরা মনেই রুমির দিকে এগিয়ে গেলাম। বইটা বাড়িয়ে ধরে বললাম, তোমাকে দিলাম।
রুমি উঠে দাঁড়িয়ে চোখ গোল গোল করেই বললো, কেনো?
আমি বললাম, আজ নব বর্ষ। নব বর্ষের মতোই তোমার আগামী দিন গুলো হউক শুভ, সুন্দর।
রুমি গম্ভীর গলাতেই বললো, না, আমি নিতে পারবো না।
আমি বললাম, কেনো?
রুমি বললো, আপনাকে আমি চিনিনা, জানিনা, কেনো নেবো?
আমি বললাম, আমার নাম খোকা, আমি তোমাকে ভালোবাসি। তাই তোমাকে ভালোবাসার উপহার হিসেবেই দিচ্ছি।
রুমি আবারো গম্ভীর গলায় বললো, না, আমি নিতে পারবো না।
আমার মেজাজটা হঠাৎই কেমন যেনো উত্তপ্ত হয়ে উঠলো। না, শব্দটা আমি কিছুতেই সহ্য করতে পারিনা। তারপরও আমি কোমল গলায় বললাম, নেবে না?
রুমি এক কথায় বললো, না। ইউনিভার্সিটির মেয়ে
আমি আর আমার মেজাজটাকে ঠিক করে রাখতে পারলাম না। বইটা ছুড়ে ফেললাম, অন্যত্র। তারপর, আর ফিরেও তাঁকালাম না রুমির দিকে। উন্মাদের মতোসিঁড়িটা বেয়ে উপরে উঠতে থাকলাম। মনে মনে বলতে থাকলাম, এই জীবনে আর ভালোবাসা নয়।
ইষ্টার পেইন্টের ম্যানেজিং ডিরেক্টর এর মেয়ে রুমি। যে ছেলেটি এতদিন রুমির পেছনে ঘুর ঘুর করছিলো, সে ক্যামিক্যাল ইঞ্জিনীয়ারিংয়েরই ফাইনাল ইয়ার এর ছাত্র ছিলো। রুমিকে প্রেম নিবেদন করেছিলো ঠিকই, কিন্তু রুমি তা দুদিনেই প্রত্যাখ্যান করেছিল। যা বুঝলাম, রুমি খুব অহংকারী মেয়ে। মানুষকে মানুষ বলেই মনে করে না। আর ছেলেদের সে কি মনে করে, তাও বুঝা যায় না। আমি ছেড়ে দেবার পাত্র না। যাকে একবার চোখে লাগে, তাকে কাছে না পেলে মাথাটা ঠিক থাকে না। অথচ, রুমি হঠাৎই ইউনিভার্সিটি যাতায়াত বন্ধ করে দিলো।
বাসে চলার পথে, ইষ্টার পেইন্ট এর বিশাল ভবনটা চোখে পরে। ভবনটা দেখলেই বুকটা হু হু করে উঠে, ওই তো রুমির বাবার বিশাল কোম্পানীটা। ওখানে গেলেই তো রুমির খোঁজ পাওয়া যাবে। ইউনিভার্সিটির মেয়ে
আমি বাস থেকে নেমে পরি। ছুটে যাই কোম্পানীর গেইটে। দারোয়ানকে বলি, এম, ডি, সাহেবের বাড়ীটা কোন দিকে?
দারোয়ান কথা বাড়ায়না, সহজ ভাবেই ঠিকানাটা বলে। আমি ছুটে ছলি রুমিদের বাড়ী। কলিংবেল টিপতে থাকি পাগল হয়ে। দরজা খুলে দাঁড়ায় রুমি। অবাক হয়ে, চোখ কুচকে বলে, তুমি? ইউনিভার্সিটির মেয়ে
আমি বললাম, অনেক খোঁজেছি তোমাকে। আমি আর পারছি না। আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচবো না রুমি!
রুমি বললো, বুঝলাম, কিন্তু তুমি আমাকে কতটা জানো?
আমি বললাম, আমি জানতে চাইনা। জানি, তুমি বিশাল ধনীর মেয়ে। তোমার অনেক অহংকার। আমার অহংকারও কম নয়।
রুমি গম্ভীর গলাতেই বললো, তুমি কি পাগল?
আমি হরবর করেই বলতে থাকলাম, তুমি পাগল বলো আর বদ্ধ উন্মাদই বলো। আমি তোমাকে ভালোবাসি।
রুমি অবাক হয়েই বললো, ভালোবাসো? একটা মানুষকে ভালো করে জানলেও না, তার কি দোষ, কি গুন, তাও জানো না, অথচ ভালোবাসো?
আমি জোড় গলাতেই বললাম, হ্যা, হ্যা, তোমাকে ভালোবাসি।
রুমি দেয়ালের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে মুচকি হাসলো। তারপর বললো, কি নাম যেনো তোমার? ডোন্ট মাইণ্ড তুমি করে ডাকছি বলে।
আমি বললাম, না, কি মনে করবো? আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমার নাম খোকা।
রুমি বললো, ও, খোকা? আমি বলি কি? তুমি একটা বোকা। ইউনিভার্সিটির মেয়ে
আমি হঠাৎই থতমত খেয়ে গেলাম। বললাম, তুমি আমাকে যত অপমান করতে পারো করো, আমি আমার মনের কথাটা তোমাকে জানাতে এসেছি। আমার বলা শেষ। আমি এখন তৃপ্ত। আমাকে যদি তোমার পছন্দ না হয়, তাহলে বলে দাও। আমি আর কখনো তোমাকে বিরক্ত করবো না। তারপরও, তুমি ঠিক মতো ইউনিভার্সিটিতে যাবে।
রুমি বললো, ইউনিভার্সিটিতে যাবো? কিন্তু কেনো?
আমি বললাম, সবাই কেনো যায়? লেখা পড়া করতে!
রুমি বিকৃত ঠোটেই হাসলো। বললো, তাইতো বললাম, আমাকে তুমি কতটা জানো? আমি কি সত্যিই ইউনিভার্সিটিতে পড়ার যোগ্য?
আমি বললাম, মানে?
রুমি বললো, আমার বাবার প্রচুর ধন সম্পদ। অশিক্ষিত মানুষ, অথচ তার অধীনে হাজার হাজার শিক্ষিত মানুষ কাজ করে। অনেক নামী দামী ক্যামিক্যাল ইঞ্জিনীয়ারও তার অধীনে। তারই তো মেয়ে আমি। আমার পড়ালেখা আর কতটুকুই হতে পারে। বাবার অধীনে ক্যামিক্যাল ইঞ্জনীয়ারদের দেখে বাবা সব সময় ভাবে, এরাই বুঝি সবচেয়ে বুদ্ধিমান। তাই আমাকেও ক্যামিক্যাল ইঞ্জইনীয়ারিং পড়াতে চেয়েছিলো। এইচ, এস, সি, ভালো মার্কস নিয়ে পাশ করেছি ঠিকই, নিজের যোগ্যতায় নয়, বাবার টাকার ক্ষমতায়। ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছিলাম ঠিকই, তাও বাবার টাকার ক্ষমতায়, একজন ক্যামিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারের সাথে বিয়ের জন্যেই।
No comments:
Post a Comment